হামিম হোসেন মণ্ডল (বুলবুল), মুর্শিদাবাদ : ১৯৮৪-তে দেশের সাধারণ নির্বাচনে তত্কালিন সিপিআই(এম) এর শীর্ষনেতা
কমরেড সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে কংগ্রেস
প্রার্থী হয় ভোটযুদ্ধে নেমেই সকলের মধ্যে প্রভূত সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন
তরুণী তুর্কী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন থেকেই মমতার জনসংযোগ ও জনপরিচিতি
গড়ে উঠতে শুরু করে। কয়েক মাসের মধ্যেই তা বেড়ে অতিপরিচিত হয়ে উঠলেন।
শিক্ষিতা যুবতি, সবেমাত্র রাজনীতির কট্টর ময়দানে নেমেছেন লম্বারেসের
ঘোড়ার সেজে।
সেই সময় সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় সানন্দা-র (১জানুয়ারি ১৯৮৭) জন্য এই উঠতি
নেত্রীর একটি সাক্ষাত্কার নেন। বিষয় ছিল 'পুরুষ চাই এইরকম'। সৌম্যর
প্রশ্ন যুবতি মমতাকে, কেমন পুরুষ পছন্দ? উত্তরে মমতা বলেন, 'পৌরুষহীন
পুরুষ আমি দেখতে পারি না। একথাটা প্রথমেই বলে রাখা ভাল। যে পুরুষ শুধু
চেহারাতেই প্রতিভাত, তাকে আমি পুরুষই বলি না। পৌরুষ আছে যার, পুরুষ তো
সেই।' এরপর তিনি প্রশ্নতুলে বলেন, 'যে ভীতু নয়, প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও যে
মাথা উঁচিয়ে চলে, তাকে পছন্দ না করে কি পারা যায়?' অর্থাত্ তিনি সাহসী ও
পরিশ্রমিকে পছন্দ করেন। এই প্রসঙ্গে আরও বলতে গিয়ে তিনি বলেন, 'জীবনে
ঝুঁকি তো আসেই। সে সময় যদি কী হবে, কী হবে ভেবে ঘরের ও মনের খিল আটকে কেউ
বসে থাকে, তাহলে সে কী করে পুরুষ হতে পারে? হারা-জেতার তোয়াক্কা না করে
যে জীবনের সংগ্রামে মাথা ঠিক রেখে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে সেই তো পুরুষ।
ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করাটা পুরুষের একটা প্রধান গুণ। এবং এমন পুরুষই আমায়
টানে।'
তিনি আরও বলেন, 'কত রকম দায়িত্ব আমাদের সমাজে পুরুষদের নিতে হয়।
সাংসারিক, সামাজিক, চাকরির ক্ষেত্রে-দায়িত্ব বহু ধরনের এবং সময়ে অসময়ে তা
অতি কঠিনও। এইসব দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েও কোনও পুরুষ যদি দেশ ও জাতির প্রতি
কর্তব্যের কিছুটা অন্তত পালন করেন, তাঁকেই আমি শ্রদ্ধা করি এবং তিনিই
আমায় আকর্ষণ করেন।' 'কারণ পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমেই একজন খাঁটি
পুরুষ ভাগ্যকে জয় করে নেন। আর খেলাধূলো ও সাংস্কৃতিক কাজকর্মের মধ্যে
থেকে চরিত্রগঠনে আর পাঁচজনকে সাহায্য করেন যিনি, তিনিই আমার কাছে
আকর্ষণীয়।'
দেখতে দেখতে ৩০বছর কেঁটে গেল তবুও তিনি তাঁর পছন্দের কাক্ষিত পুরুষের
সন্ধান পেলেননা। কিন্তু তিনি যা পেয়েছেন তা এর চেয়েও আরও অনেক অনেক দামি
তথা মূল্যবান। তিনি পেয়েছেন জনগণের অকৃত্রিম ভালোবাসা, বিপুল জনপ্রিয়তা ও
অমূল্য সম্মান। তাঁর আকাক্ষিত গুণসম্পন্ন পুরুষের সাক্ষাত্ না পেতে
পারেন! কিন্তু তিনি নিজেই সেই গুণাবলীর তথা পৌরুষত্বের অনুস্মরণকারীণি।
তিনি নিজে নারী হয়েও তাঁর মধ্যে রয়েছে তাঁর স্বপ্নের রাজকুমারের গুণাবলী।
কেবল স্রষ্টা প্রদত্ত পুরুষের বাহ্যিক গঠনটা-ই তাঁর নেই।
প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে নির্ভিক উদ্দোম গতিতে সৃষ্টিশীল মানসিকতা
আর মমতাময়ী মানবিকতা নিয়ে রাজনীতির ময়দানে হার-জিতের কুছপরোয়া না করে
জীবন সংগ্রামের ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সোনার বাংলাকে বাঁচাতে। দাঁড়িয়েছেন
বাংলার অসহায় দুর্বল দরিদ্র নিপিড়িত মানুষের পাশে। তীব্র জিহাদের ঘোষনা
দিয়েছিলেন অন্যায় ও শোষনের বিরুদ্ধে। দীর্ঘ আন্দোলনে, আন্দোলনের পর
আন্দোলনে রাস্তাকুড়ে কেটেছে তাঁর যৌবন। একসময় তিনি কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে
এসে ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নতুন একটি দল গঠন করেন। নাম রাখেন তৃণমূল
কংগ্রেস। এখন যা অতি অল্প সময়মের মধ্যেই একটি বৃহত্ সর্বভারতীয় সংগঠনে
পরিণত হয়েছে। রাজ্যের সাধারণ মানুষের দুঃখ-সুখে সর্বদা একসঙ্গে
কাঁটিয়েছেন মমতা। কখন হেঁসেছেন তো কখনও মানুষের ব্যথায় সমব্যথী হয়ে
স্বশব্দ কেঁদেছেন, কখনও নিঃশব্দ নিব্রিতে ফেলেছেন অশ্রু।
সেই কান্না, চোখের পানি, মানুষের আশা, পরিশ্রম কিছুই আজ বিফলে যায়নি।
২০১১-র বিধাসভা নির্বাচনে প্রতিপক্ষ ৩৪বছর সরকার চালানো অভিজ্ঞ শাসক দল
বামফ্রন্টকে আশাতিরিক্ত ভোট-আসলে পরাজিত করে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে তাঁর
নেত্রীতাধিন ঘাসফুলের সবুজ দল। রাজ্যে সরকার গঠন করে তাঁর নেত্রীতাধিন
বিজয়ী তৃণমূল। মুখ্যমন্ত্রীর কুরসীতে বসে উপযুক্ত নেত্রীত্বের অভাবে
জর্জরিত বিদ্ধস্ত অসহায় পশ্চিমবঙ্গের হাল ধরেন মমতা ব্যানার্জী। তাঁর
ইশারাতেই চলে রাজ্যের মন্ত্রী পরিষদ। যেন তাঁর কাছে আছে আলাদিনের আশ্চর্য
প্রদিপ, সাধারণ মানুষ থেকে নেতা-মন্ত্রী কিংবা সরকারি অফিসার সকলেরই
অভাব-অভিযোগ-আবদার তাঁরা কাছে। তিনি চলেছেন রেসের ঘোড়ার মতো দূর্বার
গতিতে দেশকে বাঁচাতে, দেশের মানুষের জন্য বাসযোগ্য একটা সুশৃঙ্খল ঐকবদ্ধ
সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এই কুমারী নেত্রীর এবারের
লক্ষ্য নয়াদিল্লীর মসনদ দখন নেওয়া। তাঁর মমতা কেবল পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে
সীমাবদ্ধ রাখতে চাননা, ছড়াতে চান গোটা দেশ জুড়ে কাশ্মির থেকে
কন্যাকুমারিকা অবধি। মা-মাটি-মানুষ যাঁর অস্থাবর-স্থাবর (প্রধান
সম্পত্তি)।
No comments:
Post a Comment