হামিম হোসেন মণ্ডল (বুলবুল) :—
২০১১ সালের ঘটনা। আষাঢ়-শ্রাবণ মাস। বর্ষাকাল, ভরাবর্ষা। আমি স্নাতক
অনার্স পরীক্ষা সেরে রাখালরাজা কিংবা চন্দ্রযানে (বাসের নাম) চেপে
ফিরছিলাম। পরীক্ষা কেন্দ্র ছিল নদীয়ার চাপড়ার বাঙালঝি মহাবিদ্যালয়ে।
থাকতাম মুর্শিদাবাদের পাটিকবাড়ী গ্রামে, নানা-নানীর বাড়িতে। যেইনা
বাসটিতে চেপে বসেছি অমনি ঘন কালো মেঘ আকাশ বিদির্ন করে অঝরে ঝড়তে শুরু
করল। কিন্তু যাইহোক যানটি শেষ সিমানায় পৌঁছতেই বারিধারা বন্ধ হল। সন্ধ্যা
নেমেছে, সাতটা সারে সাতটা হবে। ঘোলাটে আকাশে তখন কোনো নক্ষত্রের দেখা
নেই। হে আল্লাহ্ - 'আমার কাছে টর্চ-লাইট টাও নেই'। এই দূর্যোগে
ইলেক্ট্রিক বিদ্যুত্ও পালিয়েছে; ঘোর অন্ধকার বিরাজমান। নাহ্! মাঝে মধ্যে
কিছু এলোথাবারি বসতি আছে, সেখানের কেরোসিন লষ্ঠনের ক্ষীণ আলো আর ক্ষণে
ক্ষণে আকাশের বিদ্যুত্ ঝলকানিকে কাজে লাগিয়ে দু'একটা এলাকাবাসিকে
জিজ্ঞেসা করে করে ঠিক খেয়াঘাটে পৌঁছানো গেল। খেঁয়া পারে মুর্শিদাবাদ এবং
সেখানেই পাটিকাবাড়ী গ্রাম তবে লোকালয়ে পৌঁছাতে হলে খেঁয়া গাট ছাড়াও পার
হতে হবে মাঠের মধ্যদিয়ে যাওয়া একটি লম্বা রাস্তা।
এদিকে জলঙ্গী নদীর পানি ধারা বইছে আপন কলরবে। লোকজন তেমন নেয় রাস্তায়।
কিছু কিছু ফাঁকা বাড়ির বারান্দায় আর কিছু চায়ের দোকানে, দু'একটা দোকান
খোলা ছিল, জিজ্ঞাসা করে করে অর্ধেক চেনা কর্দমাক্ত রাস্তায় হোঁচট খেতে
খেতে খেয়াঘাটে পৌঁছে দেখি নৌকা-মাঝির শুন্যতা। পেছনে ফেরারও কোনও
ব্যবস্থা এবং পথ নেয়। হন্তদন্ত অবস্থায় আল্লাহর কালেমা পড়তে পড়তে
করুনাময়ের কৃপায় দৃষ্টি গোচরে এলো ওপারে নদীর তীরে হারিকেন জ্জ্বলার
ক্ষীণ আলো। ওইতো নৌক-মাঝিরা! ধড়ে পাণ এলো। কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে
নৌকা-মাঝির উপস্থিতি অনুভব পূর্বক উচ্চস্বরে করুণকণ্ঠে হাকলাম - 'ও মাঝি
ভাই, নৌকো আনুন, আমি ওপারে যাবো'। কিন্তু না, প্রতি উত্তর কিছুই এলো না।
এবার দুরু দুরু বুকে কালেমা জপে আবারও পূনরাবৃত্তি করলাম আগের ডাকটির।
হ্যাঁ, উত্তর এলো মিনিট পাঁচেক প্রতিক্ষা করতে বলে।
এরও পনেরো-বিশ মিনিট পরে ওপারে অর্থাত্ মুর্শিদাবাদে পৌঁছালাম।
ততক্ষণে সন্ধ্যা বাউড়ে রাত্রি নেমেছে ভুবনে। প্রায় পনে এক কিমির ধাক্কা,
ক্লান্ত শরীরে পায়ে হেঁটে তবেই মিলবে লোকালয়ের পাকা রাস্তা। মাঠের
কর্দমাক্ত পিচ্ছিল জনহীন রাস্তায় এই অন্ধকারে পাটের মরসুমে তাও আবার একা
উঠতি যুবক হাঁটতে হবে। ভাবলেই সারাগায়ে কাঁটা দেয়। এছাড়া অন্যকোনও উপায়ও
নেই। নিজেকে সামলে এমন একটা ভয়ানক পরিবেশের মধ্যদিয়ে চলতে লাগলাম। আমি
চিরদিনের আশাবাদী। মহান সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর আমার অগাদ
বিশ্বাস-ভরসা। আমার কিছু হবেনা, হতে পারে না!
পবিত্র কালেমা জপতে জপতে শুধুমাত্র ক্ষণেকের বিদ্যুত্ চমকের আলোকে
সঙ্গি করে দ্রুত গতিতে প্রাণপনে হাঁটে চলেছি।
গতসম্পাহে এই রাস্তাতেই বলা থাকতেই ডাকাতের একটা দল কয়েকটা পথচারীর
প্রাণ উষ্ঠাগত করে মালমত্যা সব নিয়ে চম্পট দিয়েছে এর ঘণ্টা দেড়-দুই আগে;
তারপর থেকে এই রাস্তায় সন্ধ্যের অনেক আগে থেকেই লোকজন চলাচল বন্ধকরে দেয়
- এই খবর তখনও আমার অজানা। যদি জানতেম . . . ! যাইহোক নিরুপায় হয়ে হাঁটতে হাঁটতে অর্ধেক রাস্তায় এসে কবরস্থানের
এলাকায় কিছুটা পথ গাঢ় অন্ধকার যেখানে বিদ্যুত্ ঝলকানির আলোও প্রবেশ
করছেনা; ঝিঁ ঝিঁ-র বিরামহীন শব্দে একেবারে ভূতুরে পরিবেশ, মাঝে মধ্যে
রাতের অন্য কীট-পাখিরাও বিকট আওয়াজ তুলছিল।
ভূতের থেকেও বড় ভয় ডাকাতকে। তবে এই অংশে মনেহয় ডাকাতরাও একটু হলেও ভয়
পাবে ভূতকে। লেষকালে কি এদের কারও খপ্পরে ... ! না, না; এতো কিছু ভাবার
সময় না দেওয়াই ভালো নিজেকে। ভয়কে ভয় না করে, আল্লাহর কালেমাকে একমাত্র
হাতীয়ার করে অন্ধকারে একপা দু'পা করে এগুতে এগুতে অবশেষে পৌঁছেগেলাম
লোকালয়ের পিচপাকা রাস্তায়, পৌঁছাতেই ইলেক্ট্রিক বিদ্যুত্ এলো। এবার
নিরাপদে বাড়ি চলে এলাম।
এর ঠিক পরের সপ্তাহেই বিকেল চার সারেচারটে নাগাদ এক নিঃসঙ্গ কিশোরকে
কয়েকটা শেয়ালে খামচে রাক্তাক্ত করে দেয়, আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে স্থানীয়
গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়।
বিকল্প উপায় থাকলে 'যদি জানতেম' ভালো হতো। কিন্তু নিরুপায় হয়ে অতকিছু
না জানাতেই উপকার আসে, শুধু আল্লাহ তাআলাকে ভরসা-বিশ্বাস করে হৃদয়-মাঝারে
জপতে হবে মহাস্ত্র ও মহামন্ত্র - কালেমা। তা আবারও মনে-প্রাণে উপলব্ধি
করতে পারলাম।
No comments:
Post a Comment