Followers

Sunday 24 December 2017

মিড ডে মিল, বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থা ও বাস্তবতা

দৈনিক কলম পত্রিকায় ৩০/০৮/২০১৫

মিড-ডে মিল অর্থাত্ দুপুরের খাবার, বর্তমানে স্কুলে স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের সাদরে আপ্পায়ণ করে চলেছে। তবুও অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে দৈনিক দু'পাঁচ টাকা হাতে না-পেলে স্কুলে যেতে নারাজ হয়ে পড়ে। বাড়ির উদ্দ্যোগে টিফিন সরবরাহে অক্ষম - এমন পরিবার আজকাল তেমন নেই বললে ভুল কিছু বলা হবেনা। অনগ্রসর শ্রেণি ও দরিদ্র পরিবারগুলি সরকারি একাধিক প্রকল্পের সুবিধা ভোগী। একশো দিনের নিশ্চিত কাজ এবং দু'টাকা কিলো দরে চাউল-এর সুবাদে তাদের আর অনাহারে দিন-গুজরানোর কথা নয়। শ্রমিক মুজুরীও বেড়েছে। ফলে তারাও সন্তানের জন্য টিফিনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম। অনেক পিতা-মাতা আবার স্কুলে দুপুরের খাবার সন্তানকে খেতে দিতে নারাজ থাকেন। অনেক পিতা-মাতা স্কুলের খাবার খেতে নিষেধ করেন তাঁদের সন্তানকে। পাছে ঐ খাবার খেয়ে অসুখ-বিসুখ না হয়ে পড়ে! এই ভয় দানা বেধেছে বেশ কিছু অভিভাবকের মনে। কারণ, নিকৃষ্টমানের খাবার খেয়ে, খাবারে বিষক্রিয়া ঘটে ছাত্রছাত্রী অসুস্থতার ঘটনা সংবাদপত্রের দৌলতে নতুন নয়। এমনকি মৃত্যুর মতো মর্মান্তিক দুর্ঘটনার খবর গণমাধ্যমে মেলে। কোথাও রান্না খাবারে মেলে ইদুর, টিকটিকি, আরশোলা, মাকোরশা। যখন এগুলো কোনো বড়সড় দুর্ঘটনার শামিল হয় তা সংবাদ মাধ্যমে চোখে পড়ে। ভেজাল তেল, পচা ডিম, পোকা চাউল; নানান অভিযোগ লেগেই রয়েছে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের মুখে। তবে স্কুলে খাবার পেয়ে অন্দিত ছেলে-মেয়ে ও পরিবারও কিছছু রয়েছে বৈকি। কিন্তু এই মিড-ডে মিল খেতে গিয়ে বিষক্রিয়ায় হারাতে হয়েছে বেশ কিছু তরতাজা ফুটফুটে নিষ্পাপ শিশুর জীবন। পিতা-মাতা হারিয়েছেন তাঁদের অবলম্বন, ভবিষ্যত্, অমূল্য সম্পদ। কেউ কি পারবে ঐ শিশুদের তাদের মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে? প্রশ্ন হল - মিড-ডে মিলের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী? বলার অপেক্ষা রাখেনা - আগের তুলনায় স্কুলছুটের সংখ্যা অনেকটা কমেছে। তবে সব ছাত্রছাত্রীদের স্কুলমুখী করতে এই অমৃত সুধার পরিকল্পনা তাদের শিক্ষার খোঁজ ক'জন রাখেন? পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ মামুন হোসেন জানান, 'মাসে ৪ বার জেলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে বিশেষ পরিদর্শক কমিটির সদস্যরা সারা বছর ধরে পরিদর্শন চালাবেন।' এতে জেলার বিদ্যালয়গুলিতে পঠনের মান বড়বে। (১৫/০১, কলম)। এই উদ্দোগের সাধুবাদ প্রাপ্য। আশঙ্কা জাগে - 'তোতা কাহিনী'র মতো অবস্হা হচ্ছে নাতো? মিড-ডে মিলের প্রভাবে স্কুলছুটের সংখ্যা অবশ্যই কমেছে - এটা যেমন সত্য; তেমনি এটাও সমভাবে মানে হবে - নানা কারণে ছাত্রছাত্রীদের উপর শিক্ষকদের প্রহার ও শাস্তি দানের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করে বন্ধ করা এবং অযাচিত ভাবে পড়াশোনার জন্য চাপাচাপি ও তাগিদ দেওয়ার প্রবণতা স্কুলগুলি থেকে আগের তুলনায় সভাবত অনেকটা কমে পড়া, স্কুলছুট হ্রাসের একটি অন্যতম কারণ। একসময় শিক্ষকদের নিষ্ঠুর শাস্তি ও বেত্রাঘাতের ভয়ে পড়া না-পেরে স্কুল ছাড়তে দেখাগেছে অনেক ছাত্রকে। ভুখা-পেটে পড়াশোনা না-ঢোকার ঘটনাও শামিল। নিয়মিত ফেল হয়ে স্কুল পরিত্যাগ করতে হয়েছে অল্প দিনে। তাই পাশফেল প্রথা তলানিতে ঠেকতে ফেল হয়ে স্কুল ছাড়তে হয়না আগের মতো। বদলেছে প্রশ্নপত্রের ধরণ, পরীক্ষা পদ্ধতি।
মিড-ডে মিলের সুবাদে দরিদ্র শ্রেণির কিছু মহিলা সনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে কাজ পেয়েছেন; রাধুনির কাজ। কিছু সবজি, মুদির দোকানে বেড়েছে কেনা-বেচা। স্কুলে দুপুরের খাবার থেকে অধিকাংশ রাধুনির সংগ্রহীত হয় একবেলার আহার, পরিবারও ফাঁক যায়না অনেক সময়। স্কুলে চাউল, ডাল, সবজি, সওয়া বড়ি, ডিম ইত্যাদি সামগ্রী যে উপস্হিত ছাত্রছাত্রীপিছু বরাদ্দ থাকে - সবার জানা। তবু রাধুনিরা দু'মুঠো খাবারের আশা করে তাদের বানানো খাবার থেকে। না জুটলে কটুকথা উপস্হিত শিক্ষক/সহায়িকদের কপালে ঠিক জুটে যায়। অবুঝ কিছু রাধুনি মানতে নারাজ। মিড-ডে মিল প্রকল্প সৎ থাকাকে নবএকপ্রকার চ্যালেঞ্জের সম্মুখে এনে দাঁড় করেছে। ভালো মানুষকেও চুরির রাস্তা দেখাচ্ছে এই অমৃত সুধা। রাধুনিদের আশা মেটাতে বা খরচের হিসাব মেলাতে চুরি-পন্থা ছাড়া উপায় থাকবে কি? মিড-ডে মিলে চাউল যেমন নির্দিষ্ট পরিমাণে ছাত্র/ছাত্রীপিছু বরাদ্দ থাকে, তেমনি জ্বালানি, তেল, সবজি, ডিম বাবদ একটি নির্দিষ্ট অংকের অর্থ বরাদ্দ থাকে উপস্হিত পড়ুয়াপিছু। কিন্তু বছরের সবসময় উক্ত সামগ্রীর দাম নির্দিষ্ট থাকে না। অথচ বছরের সবসময় মিড-ডে মিল মেনু ও বরাদ্দ অর্থ নির্দিষ্ট। তাই কখনো অর্থের ঘার্তি, সাশ্রয় দেখা দেয়। ফলে হিসাব মেলাতে এদিক ওদিক এর সাহায্য দরকার পড়ে। মিড-ডে মিলে বাজার করা, হিসাব রাখার দায়িত্ব রাধুনিদের হলেও অধিকাংশ রাধুনি লেখাপড়া না জানার কারণে হিসাব রাখতে অসামর্থ্য হওয়ায় এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পারিশ্রমিকহীন অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে কাঁধে নিতে হয় স্কুলের কোনো এক সহশিক্ষক/সহায়িকাকে। পড়ানো ছাড়া শিক্ষকদের আরো অনেক কাজ থেকে থাকে। প্রস্তুতিকালীন মূল্যায়নের খাতা সারা, পরীক্ষা নেওয়া ও খাতা দেখা, অন্যান্য কাজ, কারো কারো দায়িত্বে আছে ভোটের ডিও, বিএলও-এর আর্জেন্ট কাজ। ফলে এসব সামাল দিয়ে দৈনন্দিন বাজারের হিসাব রাখার দায়িত্ব সামাল দিতে স্কুলে পড়াশোনার কিছুটা হলেও ব্যঘাত ঘটার সম্ভাবনা প্রবল। দৈনিক পড়াশোনার এই ঘার্তি বছর শেষে বড় ক্ষামতিতে পরিণত হয়। ফলতঃ শিক্ষার্থীরা বার্ষিক মূল্যায়নে গণটোকাটুকিতে শামিল হয়; নতুবা মার্কশিটে নম্বরের ভাটা, খরা নামে। অন্যদিকে, বিনা পারিশ্রমিকে দৈনিক অতিরিক্ত ঝামেলা বয়েবেরাবেন কেন একজন শিক্ষক/সহায়িকা? তিনি কি সবজির ব্যবসা শুরু করবেন লাভের আশায়? একজন শিক্ষকের পক্ষে তা করা নেহাত স্বপ্ন। তবু বেকার খেটে মিলবে কটুকথা ও চোর অপবাদ। মিড-ডে মিলে গাফিলতির দায়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক গেরেফতারের ঘটনা গণমাধ্যমে মিলছে। দোকানদারও। ফলে কলঙ্কিত হচ্ছে শিক্ষক সমাজ ও শিক্ষাক্ষেত্র। অনেক শিক্ষকের মিড-ডে মিলে অনাগ্রহ তাঁদের অভিমত-এই প্রকাশ পায়। মিড-ডে মিল চালানোর অর্থ পাওয়া যায় অগ্রিম খরচ চালিয়ে হিসাব পাঠিয়ে। খরচ চালানোর এই অগ্রিম অর্থের পরিমাণ নেহাত কম নয়। দরিদ্র সংসার চালিয়ে এই অগ্রিম অর্থ গুনে টাকা ঝুলিয়ে রাখার সামর্থ্য রাধুনিদের থাকে না। ফলে বাধ্য হয়ে কোনো এক শিক্ষককে দায়িত্ব নিতে হয়। প্রাথমিক, এসএসকে, এমএসকের শিক্ষককে কোথাও ছাত্রদের সবজি দোকানে দেখা মেলে। মিড-ডে মিলের বাজার করা ও হিসাব রাখার উপযুক্ত একটি লোক রাধুনির দলে থাকলে এই সমস্যার সমাধান মিলবে। স্কুলে­ দুপুরের খাবার খাওয়ার পরে অধিকাংশ বাচ্চা বাড়িমুখী হয়ে পড়ে। বাড়ি সংলগ্ন স্কুল হওয়ার সুবাদে কিছু ছাত্রছাত্রী ভাত নিয়ে থালা হাতে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। বাকি প্রিয়োডগুলো কাটে মনযোগহীন ও কম পড়ুয়াতে। সব কাজের ফাঁকে একটু বিরতি প্রয়োজনীয়। পড়াশোনার ক্ষেত্রেও। স্কুলে টিফিন প্রিয়োডটুকু ছাত্রছাত্রীরা বিরতিরুপে সময় কাটিয়ে থাকে। কিন্তু মিড-ডে মিলের দৌলতে এই সময়টুকুও বিরাম থাকল না; দৈনিক থালা হাতে খেতে-ই ব্যস্ত থাকতে হয়। 'দুপুর বেলায় খাওয়ার পরে ঘুমাতে ইচ্ছে করে' - এই বঙ্গসন্তানের খাওয়ার পরে কতটা মনযোগ থাকছে তা পরিদর্শনের বিষয়। বর্তমান­ে সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আনাচে কানাচে গজে উঠছে বেসরকারি মিশনারী, নার্সারিগুলি। সেখানে নেই দুপুরের খাবারের ব্যবস্হা, ননেই সরকারি সুযোগ সুবিধা। বরং মাসিক ফিতে পড়াতে হয় সন্তানকে। তবু নার্সারিগুলি ছাত্রছাত্রীতে পরিপূর্ণ থাকে। এর কারণ কী? অভিভাবকরা চায় সন্তানের শিক্ষা। প্রশ্ন ওঠে - সরকারি স্কুলে কি শিক্ষা দান হয়না? যাইহোক,­ বহু চেষ্টা ও পরিশ্রমের ফলে দেশের প্রতিটি সরকারি বিদ্যালয়ে উপস্থিত পড়ুয়াদের দুপুরে খাবার দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এটা ভারতের একটি বড় সাফল্য। এমন দিনও গেছে - রাজ্যে তথা দেশে বহু ছাত্রছাত্রী কেবল ক্ষুধার জ্বালায় স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। সেখান থেকে উৎপত্তি 'শিশু শ্রমিক'-এর। বেড়েছে শিশু শ্রম। বাচ্চাদের ক্ষুধার জ্বালাকে কুকাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির দয়ালু মুখোশধারি নির্দয় ব্যক্তি তাদের বানিয়েছে 'শিশু শ্রমিক'। যে শিশু শ্রম এখনো সামাজিক ব্যধিরুপে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে মানবতাকে। এখনো এদের দেখা মেলে ইটভাঁটা, হোটেল, দোকন, পরিবহন শিল্পে। মিড-ডে মিলও এদের শ্রমের কাছে হার মানছে। তাই এদের স্কুলমুখী করতে চাই 'শিশু শ্রমিক' নির্মূল অভিযান ও যথার্থ বাস্তবায়ণ। এখনো­ কিছু কিছু ছাত্রছাত্রীর অবশ্যই মিড-ডে মিলের প্রয়োজন আছে। কিন্তু সব ছাত্রছাত্রীর প্রয়োজন রয়েছে কি? অথচ একই স্কুলে কিছু ছেলেমেয়ে দুপুরে খাবার খাবে আর কিছু ছেলেমেয়ে পাবে না - তাও অবাঞ্ছিত ও দৃষ্টিকটু বিষয়। এক্ষেত্রে অনগ্রসর এলাকা ভিত্তিক স্কুল চিহ্নিত করে প্রয়োজন সাপেক্ষে মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। দরিদ্র পরিবারের আর্থিক উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে।
(দৈনিক কলম পত্রিকায় ৩০/০৮/২০১৫-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধ)

No comments:

Post a Comment