Followers

Friday 22 December 2017

আধুনিক কবিতা মানুষের হৃদয়ের কথা বলে


আধুনিক কবিতা মানুষের হৃদয়ের কথা বলে

কলম-এ ১১ জুন ‘কলম সাহিত্য’ পাতায় পড়লাম ‘ছন্দই কবিতার প্রাণ, ছন্দময়তাই গতি’।
এখানে লেখক কুতুবউদ্দিন বিশ্বাস লেখেন, ‘ছন্দ ও সৌন্দর্য যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।’ কিন্তু সাধারণত আমরা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ বলতে বুঝি – হয় এপিঠ, নয়তো ওপিঠ। এপিঠ ওপিঠের বিপরীত, একপিঠ অন্যপিঠের বিপরীত। অর্থাৎ দুটি ঘটনা পরস্পরের বিপরীত। একটি ঘটলে অপরটি ঘটবে না। অর্থাৎ দুটি ঘটনা একসঙ্গে ঘটতে পারে না। অথচ তিনি এই উপমা যোগে বোঝাতে চেয়েছেন, - ‘পারস্পরিক সম্পর্ক যুক্ত দুই সহোদর।’ এখানে আসলে দুটি পরস্পর বিপরীত সম্পর্ক যুক্ত হয়ে পড়েছে। তিনি বোঝাতে গিয়েছেন – ‘ছন্দের গর্ভে সৌন্দর্য ও সৌন্দর্যের গর্ভে ছন্দ লুকায়িত।’ তাঁর কথায় – ‘ছন্দ মানুষের মনকে শান দেয়, সৌন্দর্য মানুষের চোখে আকর্ষিত হয়।’ প্রকৃতপক্ষে, ছন্দ সুপাঠ্য করে তোলে এবং মনকে পুলকিত করে দেয়। তিনি মনে করেন – ‘ছন্দ ও সৌন্দর্য যখন মানুষের হৃদয় গভীরে নাড়া দেয়, তকন তা কবিতার জন্ম হতে পারে।’ প্রকৃতপক্ষে কবিতার জন্ম হয় – হৃদয় মাঝারে বাস্তব অভিজ্ঞতা ও জীবনানুভূতি যথাযথ নাড়া দিলে। তাহ্ তাল, মাত্রা, লয়, ছন্দে, শব্দের বন্ধনে, ভাষার মাধূর্যে প্রকাশিত হয় কবিতা। কবিতায় ভাবার্থ থাকে, গভীর থেকে গভীরে, অন্তরে। কেবল ছন্দ হলেই তো তা আর কবিতা হয় না! হয়ে যায় ছড়া; যা শিশু-কিশোর পাঠ্য, দৈনিক কলম-এর ‘সবুজপাতা’, তাতেও মোড়াল থাকে, তবে তা আধূনিক কবিতার মতো গভীরার্থ নয়। ছন্দ বলতে কেবল শব্দের মিল কিংবা শব্দের অন্তমিলকেই বোঝায় না। গদ্য কবিতা ও আধূনিক কবিতার মধ্যেও ছন্দ রয়েছে। গদ্য কবিতা ও আধূনিক কবিতা ভাবার্থের গভীরে, ছন্দের জালে এবং শব্দের মাধূর্যে বুননো। তাই হয়তো অনেক সময় বাক্য সারল্য মনেও আধুনিক কবিতা ছন্দে, ভাবার্থে বড্ড জটিল কিংবা/ও গভীর। তাই অনেকেরই তা যথাযথ বুঝতে অসুবিধা হয়। এপ্রসঙ্গে আমজাদ আলি হালসানার অভিমত (কলম, ৩০ জুন) – ‘আধুনিক কবিতা বেসুরো নয়, সেখানেও ছন্দ থাকে’ – যথাযথ ও যথার্থ। ‘আসলে ছন্দ যে কী সেটাই কুতুবউদ্দীন বিশ্বাস বুঝে উঠতে পারেননি।’ আধুনিক কবিতার মধ্যে রয়েছে নির্ভেজাল ছন্দ এবং গভীর ভাবার্থ, আর হৃদয়স্পর্শী অনুভূতি। বুদ্ধদেব বসু (অজীর্ণ রোগে শীর্ণ, মগজ / পক্ষপাতী পাটিগণিত ঠাসা;), অরুণ মিত্র (দুব্বার কয়েকটা ছোপ / ধানের গুচ্ছের একটু ছটা), দিনেশ দাস (বেরনেট হোক যত ধারালো- / কাস্তেটা ধার দিয়ো বন্ধু!), সুভাষ মুখোপাধ্যায় (মিছিলে দেখেছিলাম একটি মুখ, / মুষ্ঠিবদ্ধ একটি শাণিত হাত / আকাশের দিকে নিক্ষিপ্ত;), বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (একবার মাটির দিকে তাকাও / একবার মানুষের দিকে।)-রা আধুনিক কবিতা লিখে জনপ্রিয়তার উপরে অবস্থান করছেন এবং বিখ্যাত হয়েছেন। এঁরা শব্দমিল বা শব্দের অন্তমিল ছন্দের বাইরে থুড়ি উর্ধে গিয়ে বক্তব্য ও অনুভূতির সমুদ্র গহ্বরে গিয়ে মানুষের হৃদয়ে গাঁথতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁদের রচিত যথার্থ আধুনিক কবিতার বলে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখলেন – ‘সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ / তবুও সবাই হাততালি দিচ্ছে।’ এই সারল্য সাধারণ বাক্যে তিনি ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতা সাজিয়েছেন, যার ভাবার্থ অসাধারণ। এটি তাঁর একটি অনন্য ও পুরস্কৃত কবিতা তথা কাব্যগ্রন্থ। এরপর তিনি বিখ্যাত। এই বিষয়গুলি হয়তো কুতুবউদ্দিন সাহেবের জানা নেই। আধুনিক কবিতা মানুষের হৃদয়ের কথা বলে তার নিজ্ ছন্দে।


(সাহিত্য অভিমত, হামিম হোসেন মণ্ডল)

No comments:

Post a Comment