ধূমপান বিষপান
হামিম হোসেন মণ্ডল (বুলবুল)
মানুষের
এক সহজাত প্রবৃত্তি বা স্বভাব হল খারাপ জিনিসের প্রতি আসক্তি। সেই থেকে শুরু
নেশাদ্রব্য গ্রহণ। আর নেশা জগতে অতিপরিচিত ও অতিসহজলভ্য নাম ধূমপান। ধূমপান শরীরের
জন্য মারাত্বক ক্ষতিকারক। ধূমপান যে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক সেকথা সিগারেটের
প্যাকেটও জানান দেয়। মরণব্যাধি ফুসফুসে ক্যান্সারসহ শাস-প্রশ্বাস নালীর কঠিন ও
জটিল অসুস্থতাসহ উচ্চ রক্তচাপের মতো কষ্টকর সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে কার্যত অবাঞ্ছিত
ভাবে ধূমপায়ীদের আয়ু অনেকাংশে কমে যায়। আয়ু কমে যাওয়ার তুলনায় আক্রান্ত জটিল
ব্যাধির পিড়া আরও ভয়ানক। সক্রিয় ভাবে ধূমপানে অংশগ্রহণ না করেও সক্রিয় ধূমপায়ীদের
সিগারেট ও মুখ থেকে নির্গত নিষাক্ত ধোঁয়ার প্রভাবে পরোক্ষ ধূমপায়ী হয়ে শাসকষ্ট,
শাসনালীতে প্রদাহ ও ফুসফুসে নানান কঠিন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আমেরিকার
প্রধান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা তথা সার্জেন ডাক্তার রেগিনা বেনজামিন বলেন, সিগারেট,
বিড়িতে টান দেওয়া মাত্রই শরীরের কেষগুলির উপর ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া সংগঠিত হতে
থাকে। যার ধারাবাহিকতার জেরে মরণরোগ ক্যান্সার দেখা দেয়। ধমনি রুদ্ধ হয়ে হার্ট
অ্যাটাক হতে পারে। এভাবে দুনিয়াবাসীকে সতর্ক বার্তা দিয়ে তিনি আবারও জানান,
প্রতিটি সুখটানেই (নিশ্চিত) শত শত বিষ রাসায়নিক পদার্থ ঢোকে শরীরে। ধূমপান বাহিত
এইসব বিষ সুখটানের সঙ্গে সঙ্গেই রক্ত টেনে নেয় এবং বিষ সমস্ত দেহযন্ত্রে ছড়িয়ে
পড়ে। বর্তমানে সিগারেটের সৌজন্যে বিষ পদার্থ নিকোটিন অতি দ্রুত আত্মসাৎ করায়।
রক্তের মধ্যে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে, ফলে রক্ত আঠালো হয়ে জমাট বাঁধতে থাকে। ইতিমধ্যে
সংকুচিত হয়ে থাকা ধমনি রক্ত জমাট বাঁধার কারণে অবরুদ্ধ হয়ে হার্ট অ্যাটাক হয় কিছু
বুঝে ওঠার আগে। অনেকে ভাবেন বিড়ি বা সিগারেট টেনে এখনও তো খুব ভালো আছি, এটা আসলে
ভুল ধারণা। আন্যদিকে কিন্তু প্রায় অধিকাংশ মানুষ (ধূমপায়ী ও অধূমপায়ী) জানেন বা
মনে করেন ধূমপান আসলে বিষপান। তবুও কিন্তু এদের মধ্যে অনেকেই ধূমপান করে থাকেন।
কিন্তু কেন? জাগে প্রশ্ন। এটাই তো আসক্তি, ঝোক, Addiction এর ফল, অর্থাৎ
নেশা।
মানুষ নেশা করে কেন? আসলে কারা
নেশা গ্রহন করে? তারা নেশাগ্রস্ত বা আসক্ত হয়ে পড়ে কখন? হতেপারে কোনো দিক দিয়ে পিছিয়ে
পড়া, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, হতাশ, অসুস্থ, বেগার বা বেকার কিংবা লোভি ভোগবিলাশিতার কারণ। জানেন,
লোভ কখনও চাহিদা পুরণ করতে দেয় না। ব্যক্তি জীবনে হতাশা, ব্যর্থতা, দুঃখ-কষ্ট,
মানসিক যন্ত্রণা কম-বেশি লেগে থাকবেই; কিন্তু, সেগুলো যখন সীমা অতিক্রমণ করে চরমে
পৌঁছোয়, যেখান থেকে সুস্থ সমাধানের মাধ্যমে শান্তি দূর-আশা তখনই অলীক সুখের মরীচিকা
নিয়ে নেশার প্রাদুর্ভাব ঘটে। হয়তো ব্যর্থতা,
দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণার উৎস ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা নিষ্ঠুর সামাজিক কিংবা
অসামাজিক, অক্ষমতা, অবাঞ্ছিত কোনো অঘটনার ফল, চিন্তাগত বা অন্যকিছু। অথবা, মৌলিক,
সামাজিক, ন্যায্য কোনো অধিকার থেকে বঞ্চনার শিকার অথবা অর্থনৈতিক অবক্ষয় যা নেশা
গ্রহণ ও আসক্তির উল্লেখযোগ্য কারণ হতে পরে।
যাইহোক, দৈনিক ইনকিলাব
(১৩-৪-২০১৬) সূত্রে, যারা ভাবছেন একবারই নাহয় ধূমপান করলাম তাদের উদ্যেশে ডাক্তার
বেনজামিনের হুঁশিয়ারি, ওই একটি সিগারেটের বিপদ সম্পর্কে ৭০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে
দাখিল করেছেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ওবামা নিশুক্ত এই সার্জেন জেনারেল। রিপোর্টে
উল্লেখ, পুয়েবলো, কলোরাতোতে নিষিদ্ধ হয় ২০০৩সালে। ঠিক তার ৩বছর পরে দেখা যায়
হার্টের অসুস্থতার কারণে ৪১শতাংশ কমেছে রোগী ভর্তির সংখ্যা, হাসপাতালে। রিপোর্ট
খতিয়ে দেখার পর নিকোটিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কে মাইকেল কামিংস মন্তব্য করেন, ধূমপান
তথা তামাকজাত যে কোনও নোশাই অবিলম্বে নিষিদ্ধ হওয়া উচিৎ। দেশের যত মানুষ হাসপাতালে
সিকিৎসাধিন তার এক তৃতীয়াংশ ধূমপানজনিত ব্যাধির কবলে। রিপোর্টে উল্লেখ, গত বছর
(২০১৫) আমেরিকায় যত লোক মারা যান তার মধ্যে প্রতি ৫জনে একজনের মৃত্যুর কারণ
ধূমপানজনিত রোগ। আরও উল্লেখ, তামাকের ধোঁয়া সাত হাজারেরও বেশি রাসায়নিক এবং যৌগ
ক্যানসার সৃষ্টিকারী। সিগারেটের চেয়ে বিড়িতে কার্বন
মনোক্সাইড এবং অন্যান্য বিষ যৌগ বেশি মাত্রায় থাকে। তাই বিড়ি বা সিগারেট ফুঁকেই
মৃত্যুর হার বেশি।
বাংলাদেশে ৪৩শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক
তামাকদ্রব্য ব্যবহার করেন। ফলে, যক্ষ্মা রোগে মৃত্যুর হারের নিরিখে বিশ্বে
ষষ্ঠস্থান দখল করে দেশটি, যে রোগে দেশটিতে প্রায় ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে।
ধূমপান মাদকদ্রব্যের তুলনায় বেশি
ক্ষতিকর। ধূমপানে কেবল ধূমপায়ীরাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়না, বরং ধূমপায়ীদের সঙ্গে সঙ্গে
প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবরা অর্থাৎ অধূমপায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
সিগারেটের উপাদান সমূহ। |
তামাকের শুকনো পাতাকে গুড়ো করে তমাল,
টেন্ডুপাতা এবং পাতলা কাগজে মুড়িয়ে বিড়ি, চুরুট বা সিগারেট প্রস্তুত করা হয়।
এগুলো প্রজ্জ্বলিত করে বিভিন্ন প্রণালীতে শ্বাসনালী ও মুখগহ্বরে তামাকের ধোঁয়া
প্রবেশ করানোর (বদ)অভ্যাস হল ধূমপান।
জাতিসংঘ রেডিও সূত্রে, বিশ্ব স্বাস্থ্য
সংস্থা (হু)-এর মতে, ২০৩০ সাল নাগাদ ধূমপানজনিত কারণে বার্ষিক মৃত্যুর হার আশি
লাখে পৌঁছতে পারে। তামাকের উপর কর বাড়ানোর জন্য এবছর সংস্থা বিশ্বের সব রাষ্ট্রকে
আহ্বান জানিয়েছে। বিশ্বব্যাপী সিগারেটের উপর পঞ্চাশ শতাংশ হারে কর বৃদ্ধি করা হলে
ধূমপায়ীর সংখ্যা কমবে প্রায় ৪ কোটি ৯০ লাখ এবং ১ কোটি ১০ লাখ জীবন বাঁচবে। ধূমপান
এতো মারাত্মক ক্ষতিকারক তবুও কেন তা তথা তামাকদ্রব্য একেবারে নিষিদ্ধ করা যাচ্ছে
না?
তথ্য বলছে, পৃথিবীতে প্রায় ১
বিলিয়নের অধিক মানুষ ধূমপান করেন। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক শিশু বিষাক্ত নিকোটিনযুক্ত
দুষিত বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে। পৃথিবীর শতকরা ৮০ভাগ ধূমপায়ী নিম্ন ও
মধ্যম আয়ের দেশের বাসিন্দা। প্রতি ৬ সেকেণ্ডে ১টি মৃত্যুর জন্য ধূমপান কোনো না
কোনো ভাবে দায়ী। বয়স্ক ১০টি মৃত্যুর ১টির সঙ্গে ধূমপানের সম্পৃক্ততা পারমাণিত।
নাইটসেড গোত্রভুক্ত একটি হার্ব
হল তামাক, যা উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা, দক্ষিণ
প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল ভ্রমণ করে বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চাষাবাদের
উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সাধারণত তামাক ও তামাকজাতদ্রব্য
গুলোকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। একটি- ধূমপানমুক্ত অর্থাৎ চিবিয়ে খেতে (সেবন) হয় বা
নস্যি হিসেবে ব্যবহৃত তামাকষ অপরটি- ধোঁয়াযুক্ত অর্থাৎ ধূমপান, যেমন- বিড়ি,
সিগারেট, হুক্কা, শিশা, পাইপ, ইত্যাদি।
এখনো অবধি সিগারেটে তথা তামাক পাতায়
১৯টি ক্যান্সারের উপাদান আবিষ্কৃত হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে – নিকোটিন, পলিনিউক্লিয়ার এ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন,
এ্যাক্রোলিন, নাইট্রোসেমাইন, সায়ানাইড, তেজক্রিয় কারসিনোজেন যেমন- লিড-২১০,
প্লামবাম-২১০, পলনিয়াম-২১০, রেডিয়াম-২২৬, রেডন-২২২ এবং বিসমাথ-২১০, ফর্মালডিহাইড,
ইত্যাদি। নিকোটিন ব্যবহৃত হয় কিটনাশক প্রস্তুতে।
সামগ্রিকভাবে সিগারেটের মধ্যে
৬০০ রকমের ক্ষতিকর উপাদান উপস্থতির সম্ভাবনা রয়েছে। যার ধোঁয়া থেকে প্রায় ৭ হাজার
ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক উৎপন্ন হয়। প্রসঙ্গত, মাউন্টসিনাই স্কুল অব মেডিকেল
ডেইলিকে বলেন, ‘সিগারেটের মধ্যে এমন শত শত উপাদান থাকে যা তামাক
গাছের মধ্যে থাকে না। এগুলো যখন পুড়তে থাকে তখন আরো নতুন
নতুন রাসায়নিক দ্রব্য উৎপন্ন হয়। এরা স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ক্ষতি সাধন
করে।’
ধূমপানের ওপর সবচেয়ে বড় এবং
দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা হল ব্রিটিশ গবেষক রিচার্ড ডল সম্পাদিত। তাতে ৩৪৪৩৯জন বিশেষজ্ঞ
চিকিৎসক, একটি অংশ ধূমপায়ী এবং বাকি অংশ অধূমপায়ীদের নিয়ে গবেষণা করেন ১৯৫১ থেকে
২০০১সাল অবধি। পর্যবেক্ষণে দেখাযায়, ধূমপায়ীরা অধূমপায়ীদের তুলনায় ১০বছর আগে মারা
যান, ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্টোকে। তারা দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থেকে মৃত্যুকে পরখ করেন।
এছাড়াও ২০০৬সালে মার্চ মাসে স্কটল্যাণ্ডের উন্মুক্ত স্থানে ধূমপান নিষিদ্ধ করার
ফলে আগের বছরের হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৭ শতাংশ কমে। এমনকি আধূমপায়ীদের
মধ্যে আগের বছরের তুলনায় ৬৭ শতাংশ কমে। সুতরাং, বোঝাযাচ্ছে অধূমপায়ীরাও ধূমপানের
শিকার ধূমপায়ীদের সৌজন্যে। আর, ধূমপান আসলে বিষপান।
[ তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট। ]
No comments:
Post a Comment