Followers

Thursday 29 September 2016

প্রসঙ্গঃ ধর্মাচরণে মুসলিম মহিলাদের অংশগ্রহণ


প্রসঙ্গঃ ধর্মাচরণে মুসলিম মহিলাদের অংশগ্রহণ



পশ্চিমবঙ্গের এক দৈনিকে, সম্প্রতি (১২ ও ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬), ইসলাম-হাদীসের আলোকে ও ইসলামি ইতিহাস থেকে তথ্য সমৃদ্ধ মুহাম্মদ ইসহাক মাদানী-র লেখা ‘ধর্মাচরণে মুসলিম মহিলাদের অংশগ্রহণ’ শিরোনামে মূল্যবান নিবন্ধটি পড়ে এবিষয়ে জেগে ওঠা কিছু জিজ্ঞাসা ও ধারণাগুলি ভাগকরে নেওয়ার জন্য এই কলাম ধরা। নিবন্ধের শুরুতেই আছে, ‘হজ প্রত্যেক মুসলিম পুরুষ ও মহিলার উপর শর্তাধীন ফরজ বা অবশ্য পালনীয়।’ অবশ্যই। এখানে ‘শর্তাধীন’ শব্দটি প্রয়োগের অর্থ হল হজ সবক্ষেত্রে বা সবার জন্য ফরজ নয়। এটাই সত্য। যেমন – পুরুষের ক্ষেত্রে মক্কা পর্যন্ত যাতায়াতের (যাওয়া ও আসার) সহায়-সম্বল (হালাল আর্থিক, দৈহিক, আইনগত, ইত্যাদি সামর্থ্য) থাকতে হবে এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে সহায়-সম্বলের সঙ্গে স্বামী অথবা ‘মোহরাম’ (যার সঙ্গে বিয়ে নিষিদ্ধ বা হারাম) এমন ব্যক্তি সঙ্গে থাকতে হবে। সুতরাং, মহিলাদের হজ পালনের ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় অতিরিক্ত আবশ্যিক সামর্থ্য থাকতে হচ্ছে। তাহলে, কোনো মহিলার সহায়-সম্বল আছে কিন্তু স্বামী অথবা ‘মোহরাম’ নেই তাঁর কাছে হজ পালন থেকে বিরত থাকা কি ফরজ হবে না? নিষিদ্ধ হবে নাকি? তেমনি সহায়-সম্বলহীন ব্যক্তির ক্ষেত্রে কোনো ভাবেই হজ পালন করা ইসলামে অসমর্থিত। 

মাদানী সাহেব যথার্থ খাঁটি কথায় লেখেন – ‘মহিলাদের একাকী যে কোনও সফর ইসলামে নিষিদ্ধ।’
 একাকী বলতে বোঝায় – স্বামী অথবা ‘মোহরাম’ ব্যক্তির সঙ্গ ছাড়া অবস্থা। নিবন্ধে উল্লেখ, ‘নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর এমন কোনও নির্দেশ পাওয়া যায় না যাতে পুরুষ ও মহিলার মধ্যে নামায আদায়ে পদ্ধতিগত কোনও পার্থক্য আছে।’ তিনি এও লেখেন, ‘শুধুমাত্র একটি বিষয়ে পার্থক্য এই যে, যদি কোনও মহিলা মহিলাদের ইমামতি করেন তবে তিনি প্রথম সারির মহিলাদের সঙ্গে কাতারের মধ্যস্থলে দাঁড়াবেন।’ অথচ, আমরা আরও জানি (নামায শিক্ষা বইগুলি দৃষ্টান্ত) সতরঢাকা বিষয় ছাড়াও নামাযের বেশকিছু বিষয়ে পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যেমন – তাকবীরে তাহরীমায় দোওয়া কুনুতের সময় আল্লাহু আকবার বলে দুই হাত তোলা কালে পুরুষ কান পর্যন্ত এবং মহিলা কাঁধ পর্যন্ত হাত তুলবে। ডান হাত বাম হাতের কব্জির উপর পুরুষ নাভির নিচে কিন্তু মহিলা বুকের উপরে তাহরীমা বাঁধবে। বসার সময় পুরুষ বাম পা বিছিয়ে ডান পা খাড়া রেখে কিবলা মুখি হয়ে বসবে, সেক্ষেত্রে নারী বা মহিলা দুই পা ডানে রেখে নিতম্বের উপর বসবে। সিজদার সময় দুই হাত বগল হতে আলাদা রাখবে পুরুষ, কিন্তু নারীরা তা যুক্ত রাখবে, এবং পুরুষের পেট উরু হতে পৃথক থকবে কিন্তু নারী যুক্ত রাখবে। এরকমভাবে পুরুষ ও নারীর নামায আদায়ের সময় কাঠামোগত, বাধ্যবাধকতাগত (বা ছাড়) তথা পদ্ধতিগত পার্থক্য লক্ষ্যণীয় (নির্দেশিত)। নামায আদায় (নামায ‘পড়া’ নয়, আদায়)-এর পাঠগত (প্রার্থনাগত) পার্থক্য না থাকতে পারে অথবা নেই, কিন্তু পদ্ধতিগত (ফরজ, উয়াজীব, সুন্নাত, মুস্তাহাব সমূহ) কিছু কিছু পার্থক্য রয়েছে। 



হামিম হোসেন মণ্ডল
দৈনিক কলম, ২২/১০/২০১৬

নিবন্ধকারের কথায়, ‘নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সাহাবায়ে কেরাম পরবর্তীদের জন্য দ্বীনের কাজে অনুসরণীয়। নিশ্চয় পুরুষদের করণীয় কাজ এবং মহিলাদের করণীয় কাজ সর্বক্ষেত্রে এক নয় – ফলে পুরুষদের জন্য পুরুষরাই আদর্শ এবং মহিলাদের জন্য মহিলারাই আদর্শ।’ অথচ কোরআন-এ পাই (আল্লাহ্ বলেন), ‘তোমাদের জন্য রাসূলের মধ্যেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।’ –(সূরা আহযাব, আয়াত : ২১)। এখানে ‘তোমাদের’ বলতে পুরুষ ও নারী নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতিকে বোঝানো ও তাদের উদ্দেশে বলা হয়েছে। অর্থাৎ, পুরুষ ও নারী সকলের জন্যই নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। পুরুষ ও নারী উভয়ের করণীয় কাজের শিক্ষা মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছ থেকে পাওয়া যায়, হতে পারে সেটা রাসূলের বিবি, কন্যা, সাহাবি কিংবা এই জাতিয় কোনো ব্যক্তির মার্ফত বা মাধ্যম তা পেতে হয় শ্রেণি বিশেষে। 


 রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেছেন, ‘সর্বোত্তম বাণী হচ্ছে আল্লাহ্-র কিতাব এবং সর্বোত্তম পথ প্রদর্শন হচ্ছে মুহাম্মদের পথ প্রদর্শন।’ –(মুসলিম)। 
মনে রাখতে হবে, রাসূল (সা.) স্বয়ং আল্লাহ্ দ্বারা নির্বাচিত সমগ্র মানবজাতির (পুরুষ, নারী, ছোট-বড় নির্বিশেষে সবার) পথ প্রদর্শক, মানবতার নেতা, ইসলামের নেতা। মহিলাদের জন্য ভিন্ন বা আলাদা বা অন্য কোনো নেতা কিংবা মহিলা নেতা বা নেত্রী কিংবা পথ প্রদর্শক আছে কি? না, নেই। ‘পুরুষরা জুম্মার খুৎবা শুনে জ্ঞানী হোক আর মহিলারা খুৎবা শ্রবণ থেকে বঞ্চিত থেকে মূর্খ থাকুক – এ রকমটা ইসলাম চায় না। ...’ অবশ্যই! কিন্তু, প্রশ্ন হল – অন্ধকার দূর করতে অন্ধকারকে আলোর কাছে নিয়ে যাওয়া যায় কি? যায় না। বরং, আলোকেই অন্ধকারের কাছে বা দিকে নিয়ে যেতে হয়; তখন-ই অন্ধকার দূর হয়। সুতরাং, জুম্মার বক্তৃতা কিংবা খুৎবার উপদেশ কেবল মসজিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না বরং তা সমাজের প্রতিটা অন্ধকারে, প্রতিটা ঘরের প্রতিটা কোণে সর্বপরি প্রতিটা মানুষের অন্তরে ও মস্তিষ্কে পৌঁছে দিতে হবে; বিশেষত নিজে তা যথাযথ পালন করার (ব্যক্তিত্বের) মধ্য দিয়ে আলো সবদিকে ও সবখানে বহিয়ে নিয়ে যেতে হবে। 

প্রত্যেক মানুষের অন্তরই হচ্ছে তার মন্দির বা মসজিদ, যেখানে ভগবান বা আল্লাহ্-র স্থান; সে মানুষ যেখানেই অবস্থান করুকনা কেন। 
 ‘ঈদের দিন কয়েকজন হাবসী বালক চামড়ার তৈরি ঢাল ও যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে খেলা করেন। আমি (হযরত আয়েশা রা.) আল্লাহ্-র রাসূলকে (খেলা সম্বন্ধে) জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন : তুমি কি এই খেলা দেখতে চাও? আমি (মা আয়েশা) বললাম, জি হ্যাঁ। তখন তিনি আমাকে তার পিছনে দাঁড় করিয়ে দিলেন – এমতাবস্থায় আমার গাল আল্লাহ্ রাসূলের গালের সঙ্গে মিলানো ছিল। ...’ –(বুখারি ও মুসলিম)। 
সুতরাং, মহিলারা খেলা দেখতে কিংবা বিনোদন সারতে পারেন কিন্তু তারও একটি আদব বা নিয়ম রয়েছে; বিকল্প নেই। কিন্তু বর্তমানে, মহিলাদের এমতাবস্থায় খেলা দেখতে দেখা যায় কি? নাকি সংশ্লিষ্ট পুরুষরা (স্বামী) সঙ্গ দেন? নাকি সমাজ এমতাবস্থায় দেখতে অভ্যস্ত? এটাই কিন্তু আদব। আর তা না হলে কীভাবে মহিলারা আনন্দ-উপভোগ করবে? অন্যভাবে তাদের এরকম আনন্দ-উপভোগ করা জায়েজ হবে কি? 
 হযরত উমর তনয় আবদুল্লাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আল্লাহ্-র রাসূল বলেছেন, তোমরা আল্লাহ্-র বান্দিদেরকে আল্লাহ্-র মসজিদসমূহে যেতে বাধা প্রদান করিও না।’ –(বুখারি, মুসলিম, আবূ দাউদ)। 
এখানে ‘রাসূল (সা.) মহিলাদেরকে মসজিদে যেতে বাধা না দিতে পুরুষদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন।’ অর্থাৎ, মহিলারা যদি মসজিদে যান পুরুষরা যেন তাদের বাধা না দেন। এখানে একটি ‘যদি’ চলে আসছে। কিন্তু, কোথাও মহিলাদের প্রতি এমন কোনো নির্দেশ দেওয়া আছে কি - যেন তারা মসজিদে যায়? নাকি পুরুষদের বলা হয়েছে স্ত্রী, কন্যাদের মসজিদে পাঠাতে? সুতরাং, মহিলাদের মসজিদে যাওয়া না-যাওয়াটা সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক বা ইচ্ছাধীন। কিন্তু, তাদের বাধা না দেওয়াটা পুরুষদের প্রতি নির্দেশ। 

 ‘নবী (সা.) শিশুদের কান্নার জন্য নামায সংক্ষিপ্ত করেছেন কিন্তু ওদেরকে মসজিদে আসতে নিষেধ করেননি।’ কিন্তু, ওদের মসজিদে আসতে নির্দেশ দিয়েছেন কি? এবিষয়ে নিবন্ধের শেষাংশে এসে যথার্থ হাদিসের বাণী উল্লেখ করেছেন মাদানি সাহেব, - ‘আল্লাহ্-র রাসূল বলেছেন, তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের মসজিদে যেতে বাধা দিও না। এবং তাদের গৃহ তাদের জন্য উত্তম।’ –(বুখারি)। একদিকে ‘তিনি (সা.) কর্তাদের মহিলাদেরকে মসজিদে যেতে বাধা দিতে নিষেধ করেছেন,’ অন্যদিকে ‘গৃহে নামায পড়া তাদের জন্য উত্তম’ বলা হয়েছে। - এটাই নিবন্ধটির যথাযথ উপসংহার এবং মূল কথা। তবুও উত্তম কাজ ছেড়ে মহিলারা যদি মসজিদ মুখি হন, তবে শরিয়ত সম্মত সফর সঙ্গ-এর সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। নিবন্ধে মহিলাদের যামাতে মহিলা ইমামতির কথা জনলাম। পুরুষ ও মহিলা একই যামাতে নামায আদায়ের কথাও জানলাম। হয়তো তখনকার সেই পরিস্থিতিতে উত্তম কাজ করতে না পারার চেয়ে নামায আদায়ের স্বার্থে পুরুষ ও মহিলাদের একই যামাতে অংশ নিতে হয়েছিল গৃহে নামায আদায়ের (প্রাসঙ্গিক) কোনো সমস্যার কারণে। তাই তাদের মসজিদে যেতে বাধা না দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল হয়তো। 

বর্তমান পরিস্থিতি কি তেমন? ইসলাম পরিস্থিতিকে মানিয়ে নিয়ে আদবের সাথে চলার শিক্ষা দেয়। যামাতে গরিব-ধনী, ছোট-বড়, রং-বর্ণ নির্বিশেষে ভেদাভেদহীন ভাবে এক হয়ে একে অপরের কাঁধে কাঁধ রেখে পাশাপাশি দাঁড়ান; যে যেখানে ইচ্ছা দাঁড়াতে পারেন, এখানে কোনো সংরক্ষণ থাকে না। কিন্তু, পুরুষ ও মহিলারা (ইসলামের ইতিহাস মতো) একই যামাতে নামায আদায় করতে দাঁড়ালে মহিলারা পুরুষদের পেছনে দাঁড়তেন নির্দেশ মতো আদব মাফিক। এখানে পুরুষ ও মহিলা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামায আদায়ের অধিকার বা অনুমতি আছে কি? তাদের গৃহে নামায আদায় করা উত্তম, আর এটাই পালন করা উচিৎ। অন্তরে পালন, লালন, বিশ্বাস, মান্য করার বিষয় হল ইসলাম; আর তা প্রকাশ্য হল সৌজন্য, দ্যুতি, ঔজ্বল্য, দ্বীপ্তি; যা নিজেরতো বটেই পারিপার্শিক সব অন্ধকার দূর করে। মূল্যবান নিবন্ধটির জন্য মুহাম্মদ ইসহাক মাদানী সাহেবকে শুকরিয়া জানাই। 


(দৈনিক কলম, ২২/১০/২০১৬) - হামিম হোসেন মণ্ডল (দৈনিকে পত্রলেখক, নিবন্ধকার, তরুণ উঠতি প্রাবন্ধিক)

No comments:

Post a Comment